সিএনবাংলা ডেস্ক: ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় একটি জনপ্রিয় যুদ্ধবিরোধী স্লোগান ছিল “তেলের জন্য রক্ত নয়”। পেট্রো-ডলার অর্থনীতিতে বাজার পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য নির্ভর করে তেলের সরবারহ ও আন্তর্জাতিক দরের ওপর। তাই মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর নজর সবসময়ই তেল নিয়ন্ত্রণের দিকে। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় কুয়েতের তেলসম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য দখলদারি অভিযান চালায় ইরাক। পরবর্তীতে কুয়েতের তেল সম্পদ নিজেদের জন্য উন্মুক্ত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কুয়েতকে ইরাকের কাছ থেকে দখল মুক্ত করে নেয়। ২০০৩ সালে একই ধারাবাহিকতায় গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুতের অজুহাতে মার্কিন জোট ইরাকে আগ্রাসন চালালেও এর পেছনে মূল কারণ ছিল ইরাকের তেল সম্পদ লুণ্ঠন। এই যুদ্ধের ফলে প্রাণহানির সংখ্যা ২ লাখ আর গৃহহীন হয়েছে ৪৫ লাখ মানুষ। “দ্য ইকোনমিস্ট” বিষয়টিকে স্বচ্ছভাবেই তুলে ধরেছে।
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য যৌথ প্রচেষ্টায় সৃষ্ট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মসাদ্দেগেরকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এর পেছনের কারণ ছিল তিনি ইরানের তেল সম্পদের ওপর থেকে ব্রিটিশ মালিকানাধীন কোম্পানি সরিয়ে তেল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ জাতীয়করণ করেছিলেন, তারই খেসারত দিতে হয়েছিল মোহাম্মদ মসাদ্দেগেরকে। পরবর্তী সময় থেকেই ইরানের জনগণ ব্যাপকভাবে পশ্চিমা-বিরোধী হয়ে উঠে। ১৯৭৯ সালে শাহ মোহাম্মদ রেজার “মার্কিন পুতুল সরকার”কে হটিয়ে আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনি যে ইসলামি বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটান এর পেছনে ইরানি জনগনের মার্কিন-বিরোধী মনোভাব ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি আর সাধারণ লিবিয়ানদেরও এই তেল সম্পদের মালিক হাওয়ার কারণে একই খেসারত দিতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের লিবিয়া আগ্রাসন এবং পরবর্তীতে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে লিবিয়া এখন এক দুঃস্বপ্নের নাম। গাদ্দাফির আমলে লিবিয়ায় যে তেল উৎপাদন হতো এখন তা এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে। অথচ তেল নির্ভর অর্থনীতির লিবিয়ার মোট রাজস্বের ৯৫% আসতো তেল থেকে। “ফরেন পলিসি” ম্যাগাজিন এক বিশ্লেষণে এমন তথ্যই পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছে।
বর্তমান সময়ে আলোচিত সিরিয়া সঙ্কটের নেপথ্যে রয়েছে সিরিয়ান তেল ভাণ্ডারের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর লালায়িত দৃষ্টি। পশ্চিমাদের দখলদারি মনোভাব আর বাসার-আল-আসাদের গোয়ার্তুমির ফলশ্রুতিতে সিরিয়ায় প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ, আর গৃহহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। আসাদ সরকার রাশিয়া ঘেঁষা হওয়ায় মার্কিন-রুশ বিরোধিতায় এই সঙ্কট ভিন্ন মাত্রায় অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধের সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে মোড় নিয়েছে। অপরদিকে, আইএস জঙ্গিগোষ্ঠী সিরিয়া ও ইরাকের যেসব তেল ভাণ্ডারের দখল নিয়েছে সেখান থেকে তেল বিক্রির মাধ্যমে বাণিজ্য করছে, ২০১৪ সালে যার পরিমাণ ছিল প্রতিদিন প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার। বিবিসির এক সংবাদিক অভিযোগ তুলেছেন, আইএস এর এই তেলের ক্রেতা তুরস্ক আর এই নিয়েই তুরস্ক-রাশিয়ার মধ্যে রয়েছে অদৃশ্য দ্বন্দ্ব।
এই তেলের জন্যই বারবার রক্তাত হয়েছে বিশ্ব। ঝরেছে অজস্র প্রাণ। তেলের মূল্য হয়ে উঠেছে রক্তের চেয়েও বেশি। মোড়ল রাষ্ট্রসমূহের আধিপত্যবাদ আর বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা কেবলই জন্ম দিয়েছে নতুন নতুন রক্তাক্ত ইতিহাস। উপসাগরীয় যুদ্ধকালীন সময়ের সেই যুদ্ধবিরোধী স্লোগান আজ প্রায় বিস্মৃত। কিন্তু বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবাইকে সমস্বরে বলতে হবে, “তেলের জন্য আর রক্ত নয়, প্রতিটি প্রাণের মূল্য মধ্যপ্রাচ্যের তেল ভাণ্ডারের থেকে শতগুণ বেশি।
সিএনবাংলা/সাকিল