ব্রিটিশ মিউজিয়ামের আল-বোখারি ফাউন্ডেশন গ্যালারি ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক চমত্কার ভান্ডার হিসেবে ইতোমধ্যে দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। এখানে রয়েছে সহস্রাধিক ইসলামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রাচীন নিদর্শন। রয়েছে নবম শতাব্দির মিশরীয় মার্বেল পাথরে কুফিক লিপিতে অংকিত ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা।
রয়েছে ১৩ শতাব্দির সোনা ও রূপায় মোড়ানো মটিফ অংকিত পিতলের ইরানী ট্রে, ১৮ শতকের সুদানী লায়ার, যা চুমকি ও মুদ্রা খচিত। আল বোখারি ফাউন্ডেশনের ২টি গ্যালারী জুড়ে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন মুসলিম দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিদ্যমান। শীঘ্রই আরেকটি গ্যালারীর উদ্বোধন করা হবে। জাদুঘরের কিউরেটর ড. লাদান আকবার্নিয়া জানান, ইতোপূর্বে ইসলামী আর্টের স্থান ছিলো জাদুঘরের সর্বনম্নি পর্যায়ে, যার ফলে দর্শনার্থীদের নজরে আসেনি এগুলো।
তিনি বলেন, এখন এসব ইসলামী প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন জাদুঘরের কেন্দ্রস্থলে দু’টো গ্যালারীতে স্থানান্তরিত হওয়ায় দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হচ্ছে। তৃতীয় গ্যালারিটি চালু হলে এর আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি পাবে।
ডঃ লাদান আরো বলেন, আগের গ্যালারীসমূহে আমরা মূলত: কেন্দ্রীয় ইসলামী ভূ-খন্ড, আরব ভূমি, ইরান, মধ্য এশিয়া ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করেছি। এই গ্যালারীতে অধিক হারে আমরা ইসলামী ভিঝুয়াল কালচার উপস্থাপনের চষ্টো করবো।
উলে্লখ্য, দু’টি কক্ষ দুইভাগে বিভক্ত। একটি কক্ষে রয়েছে ৭ম দশকে ইসলামের উত্থান থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত নিদর্শনাবলী এবং অপর কক্ষে ১৫ শতক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্যভিত্তিক চিত্রকর্ম, শিল্পকলা ও অন্যান্য নিদর্শন। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের পাশাপাশি ইসলামী গ্যালারীগুলোতে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন ইসলামী উদ্ধৃতি, অনুবাদ এবং ভিডিও ও অডিও- যা মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে দর্শনার্থীদের ধারণা দিতে সক্ষম।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহের মধ্যে মধ্য ইরাকের সামারা নগরীর ভূগর্ভ থেকে প্রাপ্ত কিছু চমত্কার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ইতোমধ্যে দর্শনার্থীদের নজর কেড়েছে। আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাসিম নবম শতাব্দীতে সামারাকে সাম্রাজ্যের রাজধানী নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষয়ে যাওয়া প্লাস্টারে খোদিত মটিফসমূহ, গ্লাস মোজাইক এবং চিত্রকর্মে ‘মাদার অব পার্লস’ সমৃদ্ধ সামারা নগরীর অতীত ইতিহাস বহন করছে।
ইরানের স্টার এন্ড ক্রস’ টাইলসগুলো অনন্য। তারকা ও ক্রসের সমন্বয় জ্যামিতিক বিন্যাসে অংকিত এই বর্ণিল টাইলস। এই টাইলসগুলো ইরানের দামঘানে অবস্থিত ইমামজাদেহ জাফরের সমাধির অভ্যন্তর ভাগ থেকে প্রাপ্ত বলে মনে করা হয়। হাজার বছরের প্রাচীন মহাকাব্য শাহনামা’র ক্যালিগ্রাফিও আছে এখানে। ৫০ হাজার শে্লাকের এই মহাকাব্যে আরব বিজয়ের পর ৫০ জন ইরানী শাসকের শাসনকাল বিধৃত হয়েছে এতে। অপর কক্ষে রয়েছে বহু সিরামিক সামগ্রী ও বাতি।
এর অনেকগুলো এনামেলে মোড়া কাঁচে তৈরী, যাতে নীল বর্ণের পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন উদ্ধৃতি উত্কীর্ণ। এর অনেকগুলোতে নীল ও লাল রংয়ের সংমিশ্রনে ফুল ও লতাপাতার মটিফ অংকিত- যেগুলো চীনা পদ্মফুলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এছাড়া মুসলিম উদ্ভাবকদের তৈরী সূর্য, চন্দ্র ও তারকাদের অবস্থানভিত্তিক সময় নির্ধারনের প্রাচীন যন্ত্রও স্থান পেয়েছে এই গ্যালারীতে। স্থান পেয়েছে সমুদ্রে দিক নির্ণয়কারী প্রাচীন কম্পাসযন্ত্র।
এছাড়া ৮ম শতাব্দি পর্যন্ত ইসলামী শাসনামলের স্বর্ণযুগে বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোবায় বিজ্ঞান, এলজাব্রা, জ্যোতির্বিদ্যা ও সাহিত্য বিষয়ক উদ্ভাবন ও নিদর্শন স্থান পেয়েছে, যখন পূর্ব ইউরোপ জ্ঞানহীনতার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলো। তখন ৭শ’ বছর ব্যাপী বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যম তথা আন্তর্জাতিক ভাষা ছিলো আরবী।
ইসলামী শিল্পকলা চীনের মতো দেশকেও তখন প্রভাবিত করেছিলো। চীনের ১৫ শতকের কিছু ইসলামী মটিফ সেই ঐতিহ্য বহন করছে। চীনের জিংদেঝেনের পোর্সেলিন সেন্টারে ১৫ শতাব্দির একটি ট্রে পাওয়া গেছে, যা মামলুক শাসনামলে প্রস্তুত ট্রের অনুরূপ। যা নীল ও সাদা রংয়ের প্রচলিত চীনা পোর্সেলিনের পরিবর্তে পিতলে তৈরী। ব্রিটিশ জাদুঘরের আল-বোখারি গ্যালারীর পৃষ্ঠপোষক সংগঠন হচ্ছে মালয়েশিয়া ভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা আল-বোখারি ফাউন্ডেশন।
সূত্র: আল জাজিরা
অনুবাদক: নিজাম উদ্দীন সালেহ, কবি ও সাংবাদিক
সিএনবাংলা/জীবন