ডা: মাও: লোকমান হেকিম:
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল চলছে। প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। অত্যন্ত মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক। সড়ক দুর্ঘটনায় নিমিষে একটি পরিবার শেষ হয়ে যায়। আমরা প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনার এসব খবর পড়তে পড়তে হৃদয়সহা হয়ে গেছে। সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে, এটাই যেন স্বাভাবিক। বাংলাদেশের সড়কে শৃঙ্খলা ফেরার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এবার ঈদ মৌসুমে সবচেয়ে বেশি মানুষ সড়কে প্রাণ হারিয়েছে কথিত দুর্ঘটনায়। এ ছাড়া আহত হয়েছেন অনেকে। বিপুল সম্পদের হানিও ঘটেছে। ‘যাত্রীকল্যাণ সমিতি’ এক সংবাদ সম্মেলনে কোরবানির ঈদের কয়েক দিনে সারা দেশের ব্যস্ত সড়কে দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরেছে। মহামারীজনিত নানা বিধিনিষেধ থাকায় এবারের ঈদে মানুষের বাড়ি যাওয়ার হার ছিল কম। সড়কে যাত্রীবাহী যানবাহনের সংখ্যাও ছিল সীমিত। এর পরও সড়কে কেন এত বেশি ‘দুর্ঘটনা’ ও প্রাণহানি ঘটছে তার ব্যাখ্যা থাকা জরুরি। নিরাপদ সড়কের জন্য এত আন্দোলন ও রক্তদান কি বৃথাই যাবে? যতসব আইনকানুন প্রণয়ন করা হয়েছে সড়কপথের নিরাপত্তায়, এসব কোনো কাজে আসেনি।যাত্রীকল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, ২৬ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে তারা দুর্ঘটনার খবর সংগ্রহ করেছেন। তাতে দেখা যায়,ওই সময়ে ১৩দিনে ২০১টি দুর্ঘটনায় ২৪২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩৩১ জন। একই সময় ৩৩টি নৌদুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৩৯ জন এবং নিখোঁজ রয়েছেন ১৭ জন। নৌদুর্ঘটনাও বাংলাদেশে আলোচিত একটা ব্যাপার। এ নিয়ে বহু আলোচনা হলেও প্রকৃতপক্ষে সংশোধন আমাদের হয়নি। অতিরিক্ত যাত্রী বহন এবং ত্রæটিযুক্ত নৌযানের কারণে ঘনঘন নৌযান ডুবে বিপুল প্রাণহানি অব্যাহত রয়েছে। মালিকদের লোভ ও সরকারের নজরদারির অভাবে এভাবে নৌরুটে প্রাণহানি বেড়েই চলেছে। অন্য দিকে, সড়কে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রাণহানি, কখনো ছাত্রদের প্রাণহানি বিভিন্ন সময় জোরদার আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু ওই সব আন্দোলনে ভুক্তভোগীদের জোরালো অংশগ্রহণের মুখে সরকারকে তাৎক্ষণিক কিছু প্রতিশ্রæতি দিয়ে পার পেতে দেখা গেছে। মোট কথা, পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা এখনো আগের মতোই রয়েছে। চুয়াডাঙ্গা- ঢাকা রোডে একটি বাস এবার বেপরোয়া চালানোর কারণে ছয়জন প্রাণ হারান। রাস্তায় ছোট তিনটি যানবাহনকে পরপর চাপা ওই চালক। বড় গাড়ির এই ভয়াবহ আচরণ আমরা লক্ষ করি সময় সময়। এটা অনেকটাই সস্ত্রাসী দুর্বৃত্তদের মতো কাজ। রাস্তায় নিজের বড় অবয়বের কারণে অন্য যানবাহন ও যাত্রীদের তারা থোড়াই কেয়ার করে। এমন বেপরোয়ামনোভাবের কারণে প্রায়ই রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটে। তাদের জন্য রাস্তায় বিভিন্ন সময় নৈরাজ্যও তৈরি হয়। আবার রাস্তায় এরা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দ্রæত সটকে পড়ে । ২০১৮ সালে ছাত্রদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাস্তায় এমন হঠকারিতামূলক গাড়ি চলাচলের বিরুদ্ধে। ওই সময় ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দুই কলেজশিক্ষার্থী প্রাণ হারানোর পর জোরালো ওই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের চাপে সরকার কিছু নিয়মকানুন পরিবর্তন এবং একটি আইন প্রয়োগ করে। এতটুকুই ছিল দুই ছাত্রের প্রাণ হারানো আর হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর আন্দোলনের ফল। যাত্রীকল্যাণ সমিতির দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, এবার ঈদে মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩২.৩৩ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৯.২৫ শতাংশ আঞ্চরিক মহাসড়কে এবং ১৩.৪৩ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। সড়কে যে বিশৃঙ্খলা তা শুধু মহাসড়কে নয়, আঞ্চলিক সড়কে আরো বেশি। ফিডার সড়কেও দুর্ঘটনা ঘটেছে। বোঝা যাচ্ছে, এসব আইনকানুন প্রণয়ন করা হয়েছে কার্যক্ষেত্রে তার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। আইনের ব্যত্যয় ঘটালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সদিচ্ছা আমাদের মধ্যে নেই । সারা দেশে যানবাহন চলাচলে তাই চলছে এক চরম বিশৃঙ্খলা, তার ফলে প্রতিদিন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। আইনপ্রণেতা ও বাস্তবায়নকারী এমনকি শ্রমিক সংগঠন ও মালিকরা হয়তো ভাবতে পারেন, তারা এসব করবেন কেন। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত, তারা নিজেরাই কখনো কখনো যাত্রী হচ্ছেন। যেকোনো সময় তারাও এমন দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। রাস্তায় এ দেশের অনেক প্রশাসক এমনকি মন্ত্রীর প্রাণও দুর্ঘটনায় গেছে। সুতরাং আমরা মনে করি, নিরাপদ সড়কের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দরকার। এ ব্যাপারে দ্রæত কিছু না করলে সামনে সমূহ বিপদ।
লেখক: শিক্ষক, কলামিস্ট