শেখ রিদওয়ান হোসাইনঃ ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট কলুষিত হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। কখনো ম্যাচ-ফিক্সিং,স্পট ফিক্সিংয়ের মতো জঘন্য ঘটনা আবার কখনো বা বল টেম্পারিং করে ম্যাচের মোড়ই ঘুরানোর বাজে চর্চা করা হচ্ছে। আজ জানবো ম্যাচ ফিক্সিং ও স্পট ফিক্সিংয়ের মধ্যে পার্থক্য কি এবং এই অশুভ চক্রটি কবে থেকে বিদ্যমান হয়েছে।
ম্যাচ ফিক্সিং;-
সহজ ভাষায় ম্যাচের জয়কে প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া। অর্থ্যাৎ ম্যাচের ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারিত করা থাকে আর মাঠে যা হয় তা ছায়াবির একটি অংশ। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময়ে ইচ্ছে করেই আউট হয়ে গিয়ে অথবা থ্রো-ওভার থ্রো করে কিংবা ভীষণ যত্ম সহকারে ক্যাচ ড্রপ করে ম্যাচ হারাকেই ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সংজ্ঞা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
স্পট ফিক্সিং;-
ম্যাচ ফিক্সিং পুরো ম্যাচ নির্ভর হলেও স্পট ফিক্সিং কিন্তু তা নয়। স্পট ফিক্সিংয়ে ম্যাচ জয় বা হারের সাথে তেমন কোনো সম্পর্ক থাকে না। তবে ক্রিকেটারদের একটু অভিনয়ই পারে টাকা বালিশের ভিতর রেখে ঘুমাতে! কিন্তু কিভাবে?
-আগেই বলেছি ম্যাচ ফিক্সিং আর স্পট দুটি কিন্তু ভিন্ন। স্পট ফিক্সিং খেলার একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়ে থাকে। একটি টি-২০ ম্যাচের ১০ম ওভারের শেষ বলে ‘নো বল’ বা ‘ওয়াইড বল’ হবে। এটি খেলার আগেই তারা জানে যারা এই ফিক্সিংয়ের সাথে সরাসরি জড়িত। বোলার ১০ম ওভারের শেষ বলটাতে ‘নো বল’ দিলো অন্যদিকে বাজিধররা উল্লাসে মাতলো। কারণ তারা কয়েক কোটি টাকা বাজি ধরে রেখেছে যে এই বলটাতে নো বলই হবে। সেই টাকা থেকে বিশাল একটা অঙ্ক উক্ত ক্রিকেটারের পকেটে যায়। কি জঘন্য একটা ব্যাপার!
ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ইতিহাস-
ক্রিকেটের একেবারে শুরুর দিকের ইতিহাস ঘাটলে এরকম কিছু খুব একটা পাওয়া যায় না। ১৮০০ এর আগের দিকে যখন ক্রিকেট ইংল্যান্ডে আস্তে আস্তে খ্যাতি পেতে শুরু করলো, তখন বাণিজ্যের দিক থেকে তাদের রমরমা ব্যবসা চলছিলো। বাণিজ্যের দাগ ক্রিকেটেও তখন দারুণ ভাবে আচড়াতে থাকে। সৃষ্ট হয় কিছু হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা।
মানুষ ধীরেধীরে ক্রিকেট নিয়ে বাজি ধরতে শুরু করলো। যা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা ও বিস্তার পেলো খুব কম সময়ের ভিতরেই। ইংল্যান্ডের সর্দার, লর্ড এবং জনপ্রিয় কিছু মানুষ দ্বারাই ফিক্সিং চলতে থাকলো। কিন্তু আজব হলেও সত্য,তখন এ নিয়ে খুবই কম অভিযোগ উঠতো! হয়তো তারা এটাকে খেলার অংশই ধরে নিয়েছিলো অথবা অভিযোগ তোলার মতো কোনো জায়গা ছিলো না! যাই হোক,ইতিহাস আরেকটু ঘাটা যাক।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রিকেট খেলা একসময় হুমকির মুখে পড়ে। সবাই এটা বুঝতে পারে যে এমন চলতে থাকলে খেলাটির অস্তিত্ব টিকানো সম্ভব হবে না। তবে ফিক্সিং বন্ধ হয় না। তরুণ ক্রিকেটাররা যখন অবকাশ যাপনে বারে কিংবা বিভিন্ন মহলে যেতো,সেখানে বুকিজ(যারা ফিক্সিং করায়) ক্রিকেটারদের সাথে আলাপ করে বিশাল অঙ্কের টাকা অফার করতো। যা দিয়ে তারা সারাজীবন চলতে পারবে। এমন লোভনীয় অফারগুলো তরুণ ক্রিকেটাররা ফিরিয়ে দিতে পারতো না।
এরকম করেই বুকিজরা লর্ডসে বসেই ব্যবসা চালাতো। ম্যাচের রেজাল্ট তারা আগে থেকেই জেনে মাঠে বসে প্লেয়ারদের লাইভ অভিনয়গুলোর প্রত্যক্ষদর্শী হতো। ঠিক এখনকার মতো আগেও সীমিত ওভারের ম্যাচগুলোতে ৩-৪ প্লেয়ারকে বুকড করে রাখতো।
এসমস্ত অভিযোগে ক্রিকেট থেকে প্রথমবারের মতো নিষিদ্ধ হোন ক্রিকেটার উইলিয়ামসন লেমবার্ট(অফিসিয়ালি না)।সেটা ১৮১৭ এর দিকের ঘঠনা। তিনি লর্ডস থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যান। তখন সন্দেহের তালিকায় আসেন অনেক নামকরা ক্রিকেটাররাও।
অবশেষে, ১৮২০ এর দশকে, ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ ফিক্সিংয়ের বিরুদ্ধ ঘুরে দাড়ালো। বুকিজদের লর্ডসের কাছ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতোটাই কঠোর হয়েছিলো যে বড় বড় অংশের ম্যাচগুলিতে ফিক্সিং একরকম অতীত হয়ে দাড়িয়েছিলো। ক্রিকেটের বর্তমান অধিপতিগণ এবং কর্তাগণ এটি আবার মূল থেকে পরিষ্কার করতে সক্ষম না হওয়ার কোনও কারণ নেই।
বর্তমান যুগের ফিক্সিং-
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে ফিক্সিং করে অনেক ক্রিকেটাররাই দেখেছেন লাইফটাইম ব্যান। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অফিসিয়ালি ২৮ ক্রিকেটারকে ফিক্সিংয়ের জন্য
শাস্তি দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৭ জন হয়েছেন লাইফটাইম ব্যান অর্থ্যাৎ ক্রিকেট থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ। তবে প্রথম ৪ জনের আজীবনের জন্য ব্যান একটা নির্দিষ্ট সময়ে এসে তুলে নেওয়া হয়েছিলো।
অফিসিয়ালি প্রথম ব্যান খান পাকিস্তানের সালিম মালিক। শুধু তাই নয়, এই অভিযোগে তিনিই প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে কারাগারের থাকার অভিজ্ঞতা নেন।
ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটার মোহাম্মদ আযহার উদ্দিনও হয়েছিলেন আজীবনের জন্য ব্যান। তবে তিনি ৪ সৌভাগ্য জনদের একজন যাদের লাইফটাম ব্যানথেকে পরে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিলো।
ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে যুক্ত হওয়া বিভিন্ন দেশ থেকে যতো ক্রিকেটার-
পাকিস্তানের – ৮ জন
১/সালিম মালিক
২/আতার-উর-রাহমান
৩/মোহাম্মদ আমির
৪/মোহাম্মদ আসিফ
৫/সালমান বাট
৬/দানিশ ক্যানেরিয়া
৭/শারজিল খান
৮/উমর আকমল
সাউথ আফ্রিকার- ৭ জন
১/হেনসি ক্রোনজ
২/হার্শেল গিভস
৩/হেনরি উইলিয়ামস
৪/গোলাম বদি
৫/থামি সলিকলে
৬/লোনওয়াবো সতসবে
৭/আলভিরো পিটারসন
ভারতের – ৪ জন
১/মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন
২/অজয় শার্মা
৩/অজয় জাদেজা
৪/মনোজ প্রভাকর
বাংলাদেশের- ৩ জন
১/মোহাম্মদ আশরাফুল
২/শরিফুল হক
৩/সাকিব আল হাসান
শ্রীলঙ্কার- ১ জন
১/কুশাল লকিরাউচিচি
হংকংয়ের- ১ জন
১/ইরফান আহমদ
আফগানিস্তানের – ১ জন
১/শফিকুল্লাহ শাফাক
কেনিয়ার- ১ জন
১/মাউরিস ওদুম্বে
নিউজিল্যান্ডের -১ জন
১/লউ ভিনসেন্ট
ওয়েস্ট ইন্ডিজের- ১ জন
১/মারলন স্যামুয়েলস
অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বাংলাদেশের পোস্টার বয় সাকিব আল হাসান কোনো ধরণের ফিক্সিং না করলেও এই লিস্টে উনার নামও আছে। তার অপরাধ ছিলো তাকে দেওয়া বুকিজদের অফার তিনি কাউকে জানাননি কেনো?
শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নয়,ডোমেস্টিক ক্রিকেটেও ফিক্সিং ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে। ডোমেস্টিক ক্রিকেটে পাকিস্তান ও ভারতীয় ক্রিকেটারদের শাস্তি পাওয়ার লিস্ট অনেক লাম্বা। আইপিএল ও পিএসএলে দেদারসে ফিক্সিং করে হয়েছেন ক্রিকেট থেকে ব্যান।
সবশেষে, বর্তমান আইসিসি ক্রিকেট বোর্ডকে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকায় তাদের সাধুবাদ দিতেই হয়। এমন শক্ত অবস্থানই পারে ক্রিকেটকে কালো দাগ হতে মুক্ত করতে। আর অবশ্যই প্লেয়ারদের আরোও সচেতন হওয়া উচিত। তাদের আরোও প্রফেসনাল মনোভাব রাখা দরকার এসব ক্ষেত্রে। কোনো প্রফেসনাল মনোভাবের ক্রিকেটারই চায় না ফিক্সিংয়ে জড়িত হয়ে জেল খাটতে। আর তাদের দেশও চায় না রত্মগুলো এভাবে হারিয়ে যাক। ক্রিকেট হোক সুস্থ,দূর্নিতী মুক্ত।
সিএনবাংলা / মান্না