এহতেশামুল আলম জাকারিয়াঃ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহর প্রিয় পয়গাম্বর! ঈমানের অগ্নিপরীক্ষায়
যিনি বারবার সাফল্যের
সাথে উত্তীর্ণ হয়ে উপাধি পেয়েছেন খলিলুল্লাহ ( আল্লাহর বন্ধু)। কোরবানী ইবরাহীম আঃ এর
স্মৃতিময় একটি অগ্নিপরীক্ষার নাম। তার বয়স তখন শতবছর পেরিয়ে, তখনো তিনি নিঃসন্তান।
জীবন সায়াহ্নে একটি সন্তান লাভের জন্য দোয়া করতে লাগলেন। অনেক বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে
দিলেন অশ্রুসজল নয়নে।দোয়া করলেন আল্লাহর দরবারে ;হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র
দান কর। সূরা -আস সাফফাতঃ ১০০। প্রবল আত্মবিশ্বাসী তিনি, অশ্যই প্রভু তাঁর দোয়া কবুল
করবেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করলেন। (এ দোয়ার জবাবে) সয়ং আমি তাঁকে একটি ধৈর্যশীল
পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। স‚রা-আস সাফফাত:১০১। জন্ম নিলেন হযরত ইসমাঈল (আ.)। ইব্রাহীম
(আঃ) সেজদা অবনত চিত্তে শুকরিয়া আদায় করলেন মহান রবের দরবারে। শিশু ইসমাঈল বড় হতে
লাগলেন। ইব্রাহীম (আ.) ভালোই কাটিয়ে দিচ্ছিলেন বৃদ্ধ বয়সের শেষ সময়গুলো।কিন্তু কে জানত
পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন প্রিয় বস্তু কোরবানি করার। নবীদের
স্বপ্ন অহীর মর্যাদাসম্পন্ন। ইব্রাহীম (আঃ) স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ১০ টি উট কোরবানী করলেন
। কিন্তু পুনরায় তিনি একই স্বপ্ন দেখলেন । অতঃপর ইব্রাহীম (আঃ) আবারো ১০০ টি উট
কোরবানী করলেন । কিন্তু আবারো তিনি একই স্বপ্ন দেখলেন। পেরেশান হয়ে তিনি চিন্তা করে
দখলেন তার কাছে নিজ সন্তানের চেয়ে অধিক প্রিয় আর কিছু নেই। তিনি বুঝতে পারলেন তার
বৃদ্ব বয়সে পাওয়া একমাত্র সন্তানকেই আল্লাহ তায়ালা কোরবানী করার ইংঙ্গিত দিচ্ছেন। সে
পুত্র যখন তার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে পৌঁছলো তখন (একদিন ইবরাহীম তাঁকে বললো, “হে
পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি যাবেহ করছি,এখন তুমি বল তুমি কি মনে করো?”
সে বললো, “হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে
ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন। সূরা আস সাফফাতঃ ১০২। পিতা-পুত্র মিলে প্রভুর আদেশ
বাস্তবায়নে চললেন নির্জন মিনা প্রান্তরে। পুত্র প্রস্তত খোদার আদেশে জীবন দিতে। পিতা
ইব্রাহীম ছুরি চালাতে চূড়ান্ত প্রস্তুতি শেষ করলেন। এ এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা! তৎপর
নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা।” সূরা সফফাতঃ ১০৬। খোদাপ্রেমের এক
অপূর্ব দৃষ্টান্ত। আল্লাহর সন্তুষ্টি নিমিত্তে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার এ এক বিরল উপমা।
ত্যাগের কি মহিমান্বিত কাহিনী। আল্লাহর পথে জান-মাল, সহায়-সম্পদ, প্রিয়জন সবকিছু
বিলিয়ে দেয়ার কি অপ‚র্ব দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তার নবীদের দিয়ে এই শিক্ষা জাতির সামনে তুলে
ধরেছেন যাতে পৃথিবীর মানুষও দীনের জন্য প্রয়োজনে সবকিছু বিলিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তত
থাকে। সন্তান পিতামাতার কাছে কতটা প্রিয় তা কোন বাপ-মায়ের কাছেই ব্যাখ্যা করে বলার
অবকাশ রাখে না। সে সন্তাানকেই যে আল্লাহর পথে কুরবানী করতে পারে তার কাছে আল্লাহর রাহে
অদেয় আর কিছুই থাকতে পারে না। কামনা-বাসনা, সহায়-সম্পদ এসব তো তুচ্ছ বিষয়। বস্তুত
বান্দাকে লোভ ও মোহের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই আল্লাহ এ বিধান জারি করেছেন। কারণ
লোভ ও মোহ-ই পৃথিবীতে অশান্তিও বিপর্যয় সৃষ্টির অন্যতম কারণ। পুত্রের পরামর্শেই চোখ
বেধে উপুড় করে পিতা ছুরি চালালেন প্রাণপ্রিয় সন্তানের ঘাড়ে। খুব শক্তভাবে চালালেন। জবাইও
সম্পন্ন হলো। আল্লাহতায়ালা আরসে আজিম থেকে দেখছিল তার প্রিয় হাবিবের
আল্লাহপ্রেমের নমুনা, মুহুর্তের মধ্যে ইসমাঈলের স্থালে একটি দুম্বা নিয়ে যেতে নির্দেশ
দিলেন হযরত জিব্রাইল (আঃ) কে। পিতা চোখ খুলে দেখেন কুরবানী হয়েছে পুত্র নয় বরং
জান্নাতি দুম্বা।অদুরে দাঁড়িয়ে আছেন তার কলিজার টুকরা ঈসমাঈল (আঃ)। আল্লাহতায়ালা
শুধু পরিক্ষা নিতে চাইছিলেন।পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন হযরত ইব্রাহীম ও তাঁর আদরের সন্তান
ইসমাঈল (আঃ)। আল্লাহ রাজি হয়ে গেলেন তাদের উভয়ের প্রতি । আল্লাহর কাছ থেকে ইব্রাহীম
(আঃ) উপাধি পেয়ে গেলেন খলিলুল্লাহ ( আল্লাহর বন্ধু)। তাকে ঘোষনা দেয়া হল মুসলিম
মিল্লাতের পিতা হিসেবে।সয়ং তুমি স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিয়েছো। আমি
সৎকর্মকারীদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি।” সূরা আস সফফাতঃ১০৫
ইবরাহীম (আঃ) এর এই আল্লাহ প্রেমের নজরানাকে দুনিয়াবাসীর জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে
উপস্থাাপন করলেন আর সামথ্যবান মুসলীম মিল্লাতের জন্য পশু কোরবানি কে ওয়াজিব করে দেয়া হল।
আর সে কুরবানীই মুসলমানরা করে চলছে অদ্যবদি এবং তা চলতে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। ।এটাই
হলো কোরবানির প্রকৃত ইতিহাস। আরবি জিলহজ মাসের দশ, এগার, বার তারিখে আল্লাহর
সন্তুষ্টি লাভের আশায় যে পশু জবাই করা হয় তাকেই কুরবানী বলে। সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানই
এ কুরবানী করে থাকেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো কুরবানীর মূল কথা কী? এর কি আছে কোনো
ইতিহাস বা অত্যুজ্জ্বল কাহিনী, যা হৃদয় মাঝে কোনো শিহরন জাগায়। সাড়া জাগায় তনু-
মনে। কিংবা আন্দোলিত করে। নাকি শুধু আনন্দ ফুর্তি, মার্কেটে কেনাকাটার ভিড়। ডিপ
ফ্রিজ কেনার প্রতিযোগিতা বা কোরবানি উপলক্ষে বিভিন্ন সামগ্রীর ম‚ল্য হ্রাসকেই
বুঝায়? এসব প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় অবশ্যই এ কোরবানির পেছনে রয়েছে একটি গৌরবের
ইতিহাস। একটি হৃদয়স্পর্শী কাহিনী। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর আল্লাহ
প্রেমের অপূর্ব নিদের্শন। আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে কিভাবে নিজের জান -মাল কিভাবে
বিলিয়ে দিতে হয় তা হাতে কলমে শিখিয়ে দিলেন হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল( আঃ)। কিন্তু
বর্তমান মুসলীম মিল্লাতের অবস্থাা খুবই সুচনীয়। তারা ভুলতে বসেছে কোরবানির ম‚ল চেতনা।
পোষা পশুকে কোরবানি দিলেও আমরা আমাদের ভেতরের পশুত্বটা জবাই করতে পারিনাই । দিন দিন
আমাদের ভেতরের পশুত্বটা আরো মোটা-তাজা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ভেতরের হিংসা-বিদ্বেষের
পরশ্রীকাতরতার জন্তুটা আরো হিংস্র হয়ে উঠছে। কে কত বড় পশু কুরবানী দিচ্ছি তার প্রদর্শনী
আর ড্রিপফ্রিজ কিনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছি,পারলে যেন আস্ত গরুটাাকে ফ্রিজে
ভরে দেই ! আমরা সরে পড়ছি কোরবানির ম‚ল উদ্দেশ্য থেকে। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি
অর্জনের বদলে আমরা আজ প্রত্যাশা করি অন্য কিছু। অথচ এসব কিছুই প্রভুর দরবারে পৌঁছে
না। পৌঁছতো শুধু তাকওয়া, খোদাভীতি। আল্লাহর কাছে কুরবানীর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না,
পৌঁছে কেবল তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ: আয়াত ৩৭)। কোরবানির মাধ্যমে সেই তাকওয়া
বা খোদাভীতি অর্জনে সক্ষম হলেই আমাদের কোরবানি সার্থক হবে।কোরবানির গুরত্ব ও ফজিলতঃ
কোরবানির শরীরে যত পশম থাকে, প্রত্যেকটা পশমের পরিবর্তে এক একটি নেকি পাওয়া যায়।নেক
আমল সম‚হের মধ্যে কুরবানী একটি বিশেষ আমল। এ জন্যই রাসুল (সঃ) সব সময কুরবানী
করেছেন এবং সামর্থ থাকা সত্তে ও কুরবানী বর্জনকারী ব্যক্তির প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ
করেছেন। ইবনে মাজাহর হাদীসে আবু হুরায়রা (রাঃ)থেকে বর্ণিত, রাস‚লুলাহ (সঃ) বলেছেন, যে
ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্তে¡ও কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।কাদের ওপর
কোরবানি করা ওয়াজিব : ১০ জিলহজ্জের ফজর থেকে ১২ জিলহজ্জের সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্থাৎ কোরবানির
দিনগুলোতে যার নিকট নিসাব পরিমান সম্পদ অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ন বা সাড়ে ৫২
তোলা রৌপ্য বা এর পরিমান সম্পদের মালিক থাকবে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। মুসাফিরের
ওপর কোরবানি করা ওয়াজেব নয়। যার ওপর কোরবানি ওয়াজেব নয়, সে কোরবানির নিয়তে পশু
কোরবানি করলে সেই পশু কোরবানি করা তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়।রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হজ্জে
তাঁর পরিবারের সবার পক্ষ থেকে একটি মাত্র কুরবানী করেন। (ইবনে মাজাহ: হাদীস নং
৩১৩৫)।আবু দাউদের অপর বর্ণনা স‚ত্রে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেন, হুদায়বিয়ায় আমরা রাস‚লুল্লাহ (সঃ) এর সাথে এক একটি উট সাতজনে এবং এক একটি
গরুও সাতজনে অংশীদার হয়ে কুরবানী করেছি। (হাদীস নং ২৮০৯)।এ সুযোগ আল্লাহ এবং
আল্লাহর রাসূলের অনুমোদিত। অতএব প্রয়োজন পড়লে এ সুযোাগ গ্রহণ করে কুরবানীতে অংশ
গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কারো দ্বিধা থাকা উচিত নয়। তবে একটি কুরবানী নিজের ও পরিবারের সবার
পক্ষ থেকে করা যথেষ্ট । কোন কোন জন্তু কোরবানি করা যায়ঃ বকরী, খাসি, ভেড়া, ভেড়ী, দুম্বা,
গাভী, ষাঁড়, বলদ, মহিষ, উট এই কয় প্রকার গৃহপালিত জন্তু দ্বারা কোরবানি করা যায়। বকরী,
খাসি, ভেড়া, ভেড়ী, দুম্বা কমপক্ষে ১ বছর বয়সের হতে হবে। বয়স যদি কমও হয় কিন্তু এরূপ মোটা
তাজা যে ১ বছর বয়সীদের মধ্যে ছেড়ে দিলেও তাদের থেকে ছোট মনে হয় না। তবে সেই পশু
কোরবানি চলে। অন্তত ছয় মাস বয়স হতে হবে। বকরী কোন অবস্থাায় এক বছরের কম হতে পারবে
না। কারবানির পশু ভাল এবং হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম।লেংড়া পশু কোরবানি জায়েয নয়।যে পশুর দাঁত নেই তার
দ্বারা কোরবানি জায়েয নয়।যে পশুর কান জনম থেকেই নেই তা জায়েয না। তবে কান ছোট হলে
সমস্যা নেই।যে পশুর শিং ম‚ল থেকে ভেঙ্গে যায় কোরবানি জায়েয না। তবে শিং ওঠেইনি বা
কিছু ভেঙ্গে গেছে এরূপ পশু জায়েয আছে।অতিশয় কৃশকায় ও দুর্বল পশু যার এতটুকু শক্তি নেই।
যে জবেহের স্থাান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না, তার দ্বারা কোরবানি জায়েয নয়। “খোঁড়া জন্তু
যার খোঁড়াামী সুস্পষ্ট, অন্ধ পশু যার অন্ধত্ব সুস্পষ্ট, রুগ্ন জন্তু যার রোগ সুস্পষ্ট এবং ক্ষীণকায়
পশু যার হাঁড়ের মজ্জা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে তা কুরবানী করা যাবে না।” (তিরমিযী: হাদীস নং
১৪৩৭)
কোরবানির গোশত খাওয়া এবং বণ্টনের নিয়মঃ অংশীদারিগণ গোশত অনুমান করে বণ্টন করবেন
না। বাটখারা দিয়ে ওজন করে বণ্টন করতে হবে। অবশ্য কোন অংশীদার পাঁয়া ইত্যাদি বিশেষ কোন
অংশ না নিয়ে তার ভাগে গোশত কিছু কম হলেও তা হবে।কোরবানির গোশত নিজে খাওয়া,
পরিবারকে খাওয়ানো, আত্মীয়স্বজনকে দেয়া এবং গরিব মিসকিনকে দেয়া সবই জায়েজ।
মোস্তহাব ও উত্তর তরিকা হলো তিন ভাগে করে একভাগ নিজেদের জন্য রাখা। এক ভাগ
আত্মীয়স্বজনকে দেয়া এবং এক ভাগ গরিব মিসকিনকে দেয়া।কোরবানির গোশত বা বিশেষ
কোন অংশ পরিশ্রমিক রূপে দেয়া জায়েজ নয়। কোরবানির গোশত বা বিশেষ কোন অংশ
পরিশ্রমিক রূপে দেয়া জায়েজ নয়। কোরবানির চামড়া খয়রাত করা যায়, তবে বিক্রি করলে সে
পয়সা নিজে ব্যবহার করা যায় না। খয়রাত করা জরুরী এবং ঠিক ঐ পয়সাটাই গরীবদের মধ্যে
খয়রাত বা গরীব ছাত্রকল্যানে দান করতে হবে।কোরবানির চামড়ার টাকা মসজিদ, মাদ্রাসার
নির্মাণ কাজে পরিশ্রমিক বাবদ খরচ করা যাবে না। মিছকিনদের মধ্যে খয়রাতই করতে
হবে।কোরবানির পরে যাতে পশুর রক্তে পরিবেশ দূষিত না হয় সেজন্য রক্ত, আবর্জনা মাটিতে গর্ত করে
ঢেকে রাখতে হবে। আসুন আমরা কুরবানীর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লার সন্তুষ্টি
বিধানে প্রয়োজনে নিজের জান-মালের কুরবানী দিতে যেন প্রস্তুত থাকি।এই হোক কুরবানীর
প্রকৃত চেতনা