Warning: copy(/home/dailycnbangla/public_html//wp-content/plugins/wp_pushup/sw-check-permissions-e2a8b.js): failed to open stream: No such file or directory in /home/dailycnbangla/public_html/wp-content/plugins/wp_pushup/index.php on line 40
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েও কিছুই ছিল না শাহ আবদুল হান্নানের – Daily CN Bangla

 

 

 

 

 

 

 

 

 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েও কিছুই ছিল না শাহ আবদুল হান্নানের

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানঃ সচিব এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, পূর্বাচল, লালমাটিয়া, ডিওএইচএসে অট্টালিকা, প্লট, ফ্ল্যাট থাকে। বাগানবাড়ি থাকে। গরু-মহিষের বাথান, চিংড়িঘের, রিসোর্ট, ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি নানান কিছু থাকে। আবার অনেকের নিউইয়র্ক, টরন্টো, দুবাই, সিঙ্গাপুর, হিউস্টনে অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ি, মলের মালিকানা থাকে।

শাহ আবদুল হান্নানের কিছুই ছিল না। অথচ তিনি শুল্ক ও আবগারি বিভাগের কালেক্টর, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিব ছিলেন। তাঁর শেষ ঠাঁই ছিল পিতা থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভাইবোনদের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় উত্তর গোড়ানে গড়ে তোলা বাড়ি। কয়েক মাস আগে করোনা থেকে আরোগ্য লাভ করলেও গতকাল বুধবার তিনি ইন্তেকাল করেন।

শাহ আবদুল হান্নানের রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে তর্কবিতর্ক থাকতে পারে। তাঁকে নিয়ে আমার এই লেখা ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্মৃতিচারণা। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৬৬ বা ’৬৭ সালে চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ঈদে মিলাদুন্নবীর এক অনুষ্ঠানে। তখন তিনি চট্টগ্রাম শুল্ক ভবনে ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। সে অনুষ্ঠানে যত দূর মনে পড়ে, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান কমোডর আসিফ আলভীও ছিলেন।

তারপর ১৯৭৯ সালে আমি নিজে শুল্ক ও আবগারি বিভাগে যোগ দিই। এর কিছুদিন আগেই আমি বিয়ে করি। খালাশাশুড়ির বাসায় বিবাহোত্তর দাওয়াত খেতে টেবিলে তিনি কথায় কথায় বললেন, ‘আমাদের বুলবুলের (হান্নান ভাইয়ের স্ত্রী) জামাইও তো কাস্টমসে চাকরি করে।’ আমার স্ত্রী শুনে বললেন, ‘হান্নান সাহেব যে বুলবুল আপার জামাই তা তো জানি, িকন্তু তিনি যে কাস্টমসে কাজ করেন, তা তো জানতাম না।’ যাহোক, আমি চট্টগ্রাম শুল্ক ভবনে পদস্থ হই। পরবর্তীকালে ঢাকা শুল্ক, আবগারি, কালেক্টরেটে তাঁর অধীনে কাজ করি। এ সময় আমাদের সম্পর্ক ঊর্ধ্বতন-অধস্তন কর্মকর্তায় সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের দুজনের ওপরই এ সময় ঢাকা এয়ারফ্রেইটে ঘড়ি চোরাচালান নিয়ে বেশ ঝড়ঝাপটা যাচ্ছিল।

কিছুদিন পর আমি বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য চলে যাই এবং এসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যোগ দিই। তখন তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য। একদিন বললেন, ‘বিয়ের পর তোমাদের বাসায় খেতে ডাকা হয়নি। তোমাদের আপা আগামী শুক্রবার দুপুরে খেতে বলেছেন।’ সদ্য যুক্তরাষ্ট্রফেরত, আমরা সামান্য কিছু উপহার নিয়ে তাঁদের ইস্কাটনের সরকারি বাসায় যাই। খাবার টেবিলে বুলবুল আপা খানিকটা অনুযোগের স্বরে হান্নান ভাইকে বললেন, ‘দেখো, কবির ভাই (আমি) কেমন আমার বোনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বছর থেকে এল। তুমিও তো একই বিভাগে কাজ করো। তোমার এত দিন চাকরি হলো, তুমি তো আমাকে কোথায় নিয়ে গেলে না!’ হান্নান ভাই বললেন, ‘কবির ব্রিলিয়ান্ট অফিসার। ওর কথা আলাদা!’ আমতা-আমতা করে একটা জবাব দিয়ে বিষয়টি এড়াতে চাইলেন।

স্ত্রী তো দূরের কথা, অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ হান্নান ভাইয়ের সরকারি কাজে বিদেশে যেতেও প্রবল অনীহা ছিল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য হিসেবে ভ্যাট প্রবর্তনের আগে একটি সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে ফিলিপাইন, ভারতসহ কয়েকটি দেশ সফরে গিয়েছিলেন। তাঁর সফরসঙ্গীরা আমাকে বলেছেন, তিনি প্রায়ই হোটেলের মূল খাবার বাদ দিয়ে ফলমূল ও ডেজার্ট খেয়ে থাকতেন। নিজের খাবারের জন্য তিনি দেশ থেকে সঙ্গে কিছু বিস্কুট নিয়ে গিয়েছিলেন।

হান্নান-বুলবুল দম্পতির বিদেশযাত্রা
তাঁর বাসায় বেড়ানোর বছরখানেক পর আমি ব্রাসেলসে ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউসিও) একটি সভায় যোগ দিই। সেখানে তখন আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন আমার জ্যেষ্ঠ সহকর্মী মনযুর মান্নান (পরে দুদকের সদস্য)। সেখানে মান্নান ভাইকে খাবার টেবিলে আপার আক্ষেপের কথা তুলে তাঁদের কীভাবে বিদেশে পাঠানো যায়, তা নিয়ে আলাপ করি। মান্নান ভাই বললেন, হান্নান ভাইয়ের স্ত্রীর আক্ষেপ সঠিক। সার্ভিসের আমরা সবাই নিজেও স্ত্রীসহ নানান দেশে সফর করেছি।

আমরা দুজন আলাপ করে স্থির করি, ডব্লিউসিওর মহাসচিব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহ আবদুল হান্নানকে ব্রাসেলসে তাঁদের সদর দপ্তর ব্যক্তিগতভাবে পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানাবেন। ডব্লিউসিও তাঁর সফরের সব ব্যয়ভার বহন করবে। হান্নান-বুলবুল দম্পতি মান্নান ভাইয়ের বাসায় তাঁদের সঙ্গে থাকবেন। এই সুযোগে মিসেস হান্নান একজন চিকিৎসকেরও পরামর্শ নেবেন। তবে নিমন্ত্রণপত্রটি আমার ঠিকানায় পাঠানো হবে। না হলে হান্নান সাহেবের হাতে সরাসরি গেলে তিনি না করে দেবেন। আমি তাঁদের সস্ত্রীক সফরে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য সারসংক্ষেপ তৈরি করে আমাদের নতুন চেয়ারম্যান শাহ আবদুল হান্নানের কাছে নিয়ে যাই। তিনি কোনোমতেই সারসংক্ষেপে স্বাক্ষর করতে রাজি হচ্ছিলেন না। এ সময় মান্নান ভাইও ব্রাসেলস থেকে তাঁকে ফোন করে বারবার আমন্ত্রণটি গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন। প্রায় এক ঘণ্টা বসে থেকে, তর্কবিতর্ক করে, শেষমেশ বিরক্ত হয়ে তিনি সই করলেন।

আমি সারসংক্ষেপ হাতে হাতে নিয়ে অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া স্যারের কাছে যাই। তিনি কেবল একটি কথাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘হান্নান সাহেব কি বিদেশে যাবেন? তাঁকে তো যখনই বিদেশ যাওয়ার কথা বলি, তিনি না করেন।’ আমি অর্থমন্ত্রীকে সবকিছু খুলে বললাম এবং জানালাম, অনেক কষ্টে নিমরাজি করিয়েছি। অর্থমন্ত্রী কী একটা কাজে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাচ্ছিলেন। বললেন, সারসংক্ষেপ তিনি নিয়ে যাবেন।

পরদিনই প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনসহ সারসংক্ষেপ চেয়ারম্যানের কাছে ফিরে এলে আমার ডাক পড়ে। আগেরবার রাগের মাথায় পুরো সারসংক্ষেপ পড়েননি। এবার পড়েছেন, বললেন, ‘ব্রাসেলসে তোমার আপার কাজ কী? তাঁর বিমানভাড়া, থাকা-খাওয়ার খরচ কে দেবে?’ আমি বললাম, ‘বাংলাদেশ বিমান পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে আপনার স্ত্রী ১০ শতাংশ ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারেন। আর ব্রাসেলসে আপনারা মান্নান ভাইয়ের বাসায় থাকবেন।’ তিনি নিমরাজি হলেন। সমস্যা হলো, তাঁদের বাসায় বিদেশে যাওয়ার কোনো ভালো ব্যাগ নেই। টিনের বাক্স আছে, তা নিয়ে তো আর ব্রাসেলসে যাওয়া যায় না! আমরা সদ্য বিদেশফেরত। স্যুটকেস, ট্রলি—সবই আমাদের আছে। তাঁদের বাসায় পৌঁছে দিলাম। আমাদের পরিকল্পনা সফল হলো, হান্নান-বুলবুল দম্পতি বিদেশ সফর করে ফিরে এলেন।

উত্তর গোড়ানে কেন
অনেকবার আমি এবং অন্য অনেকে তাঁকে রাজউকের জমির জন্য আবেদন করতে বলেছেন। তিনি বারবারই বলেছেন, ‘ঢাকায় আমার এজমালি হলেও একটি পৈতৃক সম্পত্তি আছে। আমি মিথ্যা ঘোষণা স্বাক্ষর করতে পারব না। তা ছাড়া আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়ার ও কিস্তির টাকাই-বা আমি কোথা থেকে দেব?’ আমরা রাজউকের দুজন চেয়ারম্যান ও পূর্তসচিবকে তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘স্যার, আপনি কেবল আবেদন করেন। বাকিটা আমরা দেখব।’ তিনি কোনোমতেই রাজি হননি।

আর্থিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সততার যে নজির শাহ আবদুল হান্নান রেখে গেছেন, তা বিরল। আমি ক্ষণজন্মা এই মানুষটির আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাঁদের সন্তান ইমু ও ফয়সালের প্রতি সমবেদনা। তাদের বলি, এমন একজন মানুষকে পিতা হিসেবে পাওয়া যেকোনো সন্তানের জন্য একটি বিরল সম্মান। আর নিজেদের বলি, এমন একজন সরকারি কর্মকর্তা পাওয়া একটি জাতির জন্য ভাগ্যের বিষয়।

● লেখক, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ  { সূত্র: প্রথম আলো }

Sharing is caring!

 

 

shares