মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম
এবার পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচন নিরবে উপভোগ করছিলাম। বেশ আগ্রহ নিয়ে পরিস্থিতি অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। টানা তৃতীয় বারের মতো বিশাল ব্যবধানে বিজয় পেয়েছে মমতার দল TMC. ‘খেলা হবে’ গানের লিরিক্সের এই শ্লোগান নিয়ে প্রচারনায় ছিলেন মমতা। পা মচকে যাওয়ায় হুইল চেয়ারে বসে প্রায় সবক’টি জনসভায় বক্তৃতা করেছেন। ২৯৪ আসনের মাঝে ২৯২ আসনে ইলেকশন হয়। ডাবল সেঞ্চুরির ঘোষনা দিয়ে দিদি তুলে নিলেন ২১২ সীট।
মোদিও কম যান নি। দেশের প্রধান মন্ত্রী হয়েও রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেছেন। দিদিকে তীর্যক বাক্যবানে জর্জরিত করছেন। জনসভায় ‘দি—দি ও দি—দি’ বলে ভেঙচি কেটেছেন। কিন্তু তিনি হালে পানি পাননি। জুটেছে মাত্র ৭৮ সীট।
যুবক-যুবতি, তরুন-তরুনীদের মাঝে ব্যাপক আশার সঞ্চার সৃষ্টি করেছিল সংযুক্ত মোর্চা ISF. বাম ডান ধনী গরীব ধর্ম গোত্র বর্ণ নির্বিশেষে এ মোর্চা গঠিত হয়। অতীতে টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা কিংবদন্তি শাসক জ্যোতি বসুর CPIM এর সাথে মুসলিম ফ্লেভার নিয়ে যুক্ত ছিলেন ফুরফুরার নেতৃত্ব।
CPIM এর প্রচারনায় গ্ল্যামার ছিল, সাংস্কৃতিক উচ্ছাস ছিল। তাদের প্রার্থীরা বেশির ভাগই তরুণ এবং অল ইন্ডিয়ান ছাত্র ফেডারেশনের রানিং ছাত্র নেতা-নেত্রীরা ছিল। তারা অসম্ভব মেধাবী। বেশির ভাগই কমরেড। তারা ব্রিগেডের বিশাল সম্মেলনও করেছিল। বিগত মমতা শাসনামলে তাদেরকে অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কমরেডসহ প্রায় ২৮০ জন সাথীকে জীবন দিতে হয়েছে।
লাল ঝান্ডাধারী কমিউনিস্ট আদর্শের CPIM ১৫ বছর পর পূর্ণ শক্তি নিয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে নামে; তা-ও ধর্মীয় নেতৃত্বের সাথে মোর্চা করে। ‘খেলা নয় কাজ হবে’ শ্লোগান নিয়ে তাদের বিশাল বিশাল শো ডাউন ও নান্দনিক প্রচারনা ‘হল্লা গাড়ি’ সাড়া জাগিয়েছিল। হাতে হাতে শোভা পাচ্ছিল লাল ঝান্ডা। গনতন্ত্র, ভোটাধিকার, কর্মসংস্থান ও ভাতের কথা প্রশংসা কুড়িয়েছে। শেষতক শোচনীয় ভাবে পরাজিত হতে হলো তাদেরকে। শুধুমাত্র ভাঙগরের আসনে ফুরফুরার নওশাদ সিদ্দিকি উৎরে যান। অন্যরা পায় একটি আসন।
বস্তত: থার্ড ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স ও উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে আদর্শিক তথা বাম ও ধর্মীয় পলিটিক্স নানা কারনে অপাংক্তেয় হয়ে উঠেছে। বাম ও ধর্মীয় রাজনীতিকে সাম্রাজ্যবাদী, পূঁজিবাদী ও আগ্রাসী শক্তি নানা ভাবে দমিয়ে রেখেছে। আদর্শিক রাজনীতিকে তারা অপ্রাসঙ্গিক ও কোনঠাসা করে রেখেছে। বাস্তবিক পক্ষে উপমহাদেশ ও তৃতীয় বিশ্বের জনসাধারনের রক্ত মাংসে এক ধরনের বস্তুবাদি চিন্তাধারা গেড়ে মিশে আছে।
এই বর্জোয়া রাজনীতির মাঠে আদর্শিক রাজনীতি নিশ্চয়ই চাপের মুখে পতিত। অনেকটা অনিশ্চিত যাত্রা। আদর্শিক দলগুলো হোমওয়ার্ক,পেপার ওয়ার্ক, স্ট্যাটিসটিক্স, ঘরোয়া সভা, অফিস মেইনটেইনে বেশি ব্যস্ত। এতে কিছু এলিটস ও বুদ্ধিজীবী মার্কা নেতৃত্ব তৈরি হলেও কার্যত: সার্বিকভাবে কিছু ভাল মানের কেরানি তৈরি হচ্ছে। এসব দিয়ে আদর্শিক বিজয় হয় ঠিক, কিন্তু নির্বাচনী ও রাজনৈতিক বিজয় সম্ভব নয়।
অন্তত পশ্চিমভঙ্গের নির্বাচন জানিয়ে দিল লিবারেল ( আদর্শবাদিদের ভাষায় বর্জোয়া) রাজনৈতিক দলে জীবনঘনিষ্ঠ ও জনসম্পৃক্ত নেতৃত্ব অটোমেটিক তৈরি হয়ে যায়, যার দ্বারা তারা সহজেই নির্বাচনী বৈতরনী পার হতে সক্ষম, যা আদর্শিক রাজনীতিতে অনেকটা সম্ভব নয়। তবে এটা স্পষ্ট যে, আদর্শিক রাজনীতি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহন করতে না পারলেও ফ্যাক্টর হিসেবে থাকবে।
লেখক: আইনজীবি ও সম্পাদক, সাপ্তাহিক সীমান্ত কন্ঠ।